হৃদয়ের বন্ধন

হৃদয়ের বন্ধন
-চিন্ময় মহান্তী

 

 

দশম বর্ষীয় বালক পলাশ কয়েকটি কদলীর কান্ড জোগাড় করিয়া বিচুলি দড়ি দিয়া সারিবদ্ধ করিয়া বাঁধিয়া ভেলা বানাইয়া, রায় পুষ্করিণীর জলে ভাসাইয়া দিয়া এক টুকরা বংশ দন্ড লইয়া বারংবার জলের বক্ষে প্রোথিত করিয়া পুনরায় তুলিয়া লইতে লইতে ক্রীড়া মগ্ন হইয়াছিল। ভেলাটি ক্রমান্বয়ে ঘাট হইতে দূরে সরিয়া যাইতেছিল। পুষ্করিণীর পাড় দিয়া একটি পথ সর্পিল আকৃতি ধারণ করিয়া ক্ষেত অবধি বহিয়া গিয়াছে। ইহা যে মনুষ্য পদ কর্ত্তৃক সৃষ্ট তাহা তাহার স্বাস্থ্য দেখিয়া অতি সহজেই অনুমেয়। গ্রামের লোক ক্ষেতে যাইবার পথের দৈর্ঘ্য কিঞ্চিৎ স্বল্প করিয়া লইয়াছে। পলাশের পিতা জল ও কাঁচা লংকা সহযোগে কয়’টা মুড়ি খাইয়া হাতে একটি কাস্তে এবং কাঁধে কোদালটি লইয়া ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বাহির হইল। পুষ্করিণীর পাড়ে আসিয়া তাহার পুত্রকে জলে ক্রীড়া মগ্ন দেখিয়া ধমকাইয়া বলিল, ”ইস্কুলে যাবার নাম নাই, সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। আমি যেন এসে দেখি তুই ইস্কুলে গেছিস। ”ছেলে পিতার কথায় কর্ণপাত করিল বলিয়া মনে হইল, ভেলার গতি স্থির হইল। পিতা হনহন করিয়া চলিয়া গেল। পলাশ খেলা থামাইয়া ভেলার উপর বসিয়া রহিল। কিঞ্চিৎ পূর্বের তাহার আনন্দ বর্তমানে বিষাদে পরিণত হইল।

শিমুল স্কুলে যাইবার নিমিত্ত পুষ্করিণীতে স্নান করিতে আসিল। সে পলাশের সহিত গ্রামের বিদ্যালয়ে একই শ্রেণীতে পাঠরত। তাহাদের বন্ধুত্ব দেখিয়া একদিন ভূগোলের মাস্টার মিশ্রবাবু বলিয়াছিলেন, ”তোরা এক আত্মা।” মাস্টারের কথার অর্থ পলাশ এবং শিমুল কেহই বোঝে নাই। যাহা হোউক পুষ্করিণীতে আসিয়া শিমুল দেখিল পলাশ ভেলার উপর নিশ্চুপ বসিয়া রহিয়াছে। সে তাহার নিকট গিয়া ভেলার উপর চড়িয়া বসিল। তৎক্ষণাৎ পলাশ তীব্র চিৎকার করিয়া বলিল, ”তুই আমার ভেলায় চাপলি কেন?” শিমুল কিছু একটা বলিতে যাইতেছিল কিন্তু পলাশ তাহার অপেক্ষা না করিয়া সহপাঠীর পৃষ্ঠে দমাদম কিল মারিল। পিতার প্রতি সঞ্চিত ক্রোধ বন্ধুর উপর বর্ষিত হইল। শিমুল কাঁদিতে কাঁদিতে পুষ্করিণী হইতে সিক্ত বসনে গৃহের অভিমুখে চলিল। পলাশ ভেলার উপর তেমনই বসিয়া রহিল।

শিমুলের পিতা কুড়ুল লইয়া কয়েকটি শিরিষ কান্ডকে চেলা করিয়া রন্ধনকার্যে ব্যবহারোপযোগী করিতেছিল। পুত্রকে ক্রন্দনরত অবস্থায় আসিতে দেখিয়া হাতের কুড়ুলটি ফেলিয়া রাখিয়া তাহার ক্রন্দনের কারণ জানিতে চাহিল। শিমুল পূর্ববৎ কাঁদিতে কাঁদিতেই রায় পুষ্করিণীতে ঘটিয়া যাওয়া সমস্ত ঘটনা পিতার নিকট সবিস্তারে ব্যক্ত করিল। শিমুলের পিতা যারপরনাই ক্রুদ্ধ হইয়া হনহন করিয়া পলাশের গৃহ অভিমুখী হইল

পলাশের মাতা গৃহ অভ্যন্তরে আপন কর্মে ব্যস্ত রহিয়াছিল। উঠান হইতে শিমুলের পিতা অমূল্য হাঁক পাড়িল, ”বলি ও পলাশের মা ঘরে আছো?” একটা ঝাঁঝালো ডাক শুনিয়া পলাশের মাতা সুনীতি বাহিরে আসিল। তাহাকে দেখিয়া অমূল্য তীক্ষ্ণ স্বরে বলি , ”ছেলেটাকে তো মানুষ করতে পারলে না। একটা বেয়াদপ ছেলে গর্ভে ধরলে।” সুনীতি কিছু না বুঝিয়া বলিল, ”কেন কি হয়েছে?”

”তোমার ছেলেকেই সেটা জিজ্ঞাসা কর, অমানুষ কোথাকার,” বলিয়া অমূল্য বিদাই হইল। অমূল্যের মুখ হইতে তীব্র বাক্য ঝাঁঝ সহ্য করিয়া সুনীতি চালার খুঁটিতে ঠেস দিয়া বসিয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পর পলাশ পুষ্করিণী হইতে ফিরিয়া আসিল। মাতা কিছু না বলিয়া তাহার চুলের মুষ্ঠি ধরিয়া গৃহাভ্যন্তরে লইয়া গিয়া বেদম প্রহার করিল। পলাশ হাউহাউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। কিন্তু তাহাতেও তাহার মাতার শান্তি হইলো না। পলাশের পিতা শীঘ্রই ক্ষেত হইতে ফিরিয়া আসিল। তাহার হাতে একঘটি জল দিয়া সুনীতি অমূল্য কর্ত্তৃক গৃহে বহিয়া আসিয়া অপমান করিয়া যাওয়ার কথা সবিস্তারে বর্ণনা করিল। সুনীতির স্বামী প্রদীপ দাউদাউ করিয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। ঘটির জল একনিঃশ্বাসে পান করিয়া সে বাহির হইয়া গেল। অমূল্যকে একটি মোক্ষম জবাব দিয়া প্রদীপ আসিবে ইহা মনস্থির করিয়া সুনীতি শান্তি পাইল।

প্রদীপ যখন অমূল্যের গৃহে আসিল তখনও অমূল্য সেই শিরিষ কান্ডে কোপ মারিতেছিল। প্রদীপ তাহার সম্মুখীন হইয়া বলিল, ”আমার ছেলে বেয়াদপ তো তোর ছেলেকে মিশতে দিস না আর আমিও দেবো না।” অমূল্য সায় দিয়া বলিল, ”হ্যাঁ হ্যাঁ যা ওটাই হবে। আর তুই আমার ঘরের ত্রিসীমায় আসিস না যা।” প্রদীপ কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। দুইটি বালকের ঠুনকো ঝগড়া লইয়া উভয় গৃহস্থ গোল পাকাইয়া দিল। বাল্যের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অবগত নয় বলিয়া দুইটি বাল্য হৃদয়কে জোর পূর্বক পৃথক করিল। এই স্থলে শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হইল।

পরের দিন শিমুল এবং পলাশ স্কুলে আসিল। বারংবার এ ওর মুখের প্রতি চাহিতে লাগিল। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোনোরূপ বাক্য বিনিময় হইল না। শিমুলের মনে ভাসিয়া উঠিল তাহার পিতার নিষেধবানী, ”পলাশের সঙ্গে যদি কথা বলিস তো মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেবো।” পলাশের মনে ভাসিয়া উঠিল পিতা কর্ত্তৃক আরোপিত অনুরূপ নিষেধবানী। বারংবার ইচ্ছা হইল একে অপরকে গিয়া জড়াইয়া ধরে কিন্তু নিষেধের দুর্ভেদ্য প্রাচীর খাড়া হইয়া তাহাদের ইচ্ছাকে টুঁটি টিপিয়া মারিল। 

পূর্বোক্ত ঘটনার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হইয়াছে। পলাশ এবং শিমুলের লেখাপড়ার বিশেষ অগ্রগতি হয় নাই। পারিবারিক অর্থাভাব তদুপরি লেখাপড়ার প্রতি উভয়ের অনাগ্রহই ইহার হেতু হইয়াছে। পলাশ অষ্টম শ্রেনীতেই তাহার লেখাপড়ার বৈতরণীকে অকূল পাথরে নিমজ্জিত করিয়াছে। শিমুল দশম শ্রেণীর গন্ডি টপকাইতে ব্যর্থ হইয়াছে।
সেইদিনের দুই বালক পলাশ এবং শিমুল বর্তমানে বিশ বছর অতিবাহিত করিয়া যুবক হইয়াছে। সেই যে তাহাদের বাক্যালাপ বন্ধ হইয়াছে তাহা ক্রমান্বয়ে অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে। কোনো স্থানে দুইজনের মুখোমুখি দেখা হইয়া গেলে একে অপরের মুখের প্রতি চাহিয়া সেই স্থান ত্যাগ করে, ইহাও নিত্য হইয়াছে। গ্রামের অদূরে একটি কারখানা রহিয়াছে, শিমুল সেই কারখানায় শ্রমিকের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছে। পলাশ পিতার সহিত ক্ষেতের কর্মে নিযুক্ত হইয়াছে।

অদ্য প্রাতে ঘুম হইতে জাগিয়া পলাশ একটি সম্বর কাঠিকে দাঁতন বানাইয়া উঠানে রাখা একটি বড় গাছের গুঁড়ির উপর বসিয়া দাঁত মাজিতেছিল। গতরাত্রিতে অসহ্য গরমের কারণে ঘুম ধরিতে মধ্যরাত্রি পার হইয়া গিয়াছিল বলিয়া অদ্য জাগিতে কিঞ্চিত বিলম্ব হইয়াছে। প্রভাতের রবি আপন মহিমায় মহিমান্বিত হইয়া ততক্ষণে তাহার ক্ষমতা প্রদর্শন করিতে শুরু করিয়াছেন। পলাশ দেখিল শিমুল সাইকেল চালাইয়া কারখানার উদ্দেশ্যে চলিয়া গেল। মুখ ধুইয়া উঠান হইতেই সে হাঁক দিল, ”মা, পান্তা নিয়ে আয়।” তাহার মাতা একটি থালায় করিয়া কয়েকটা চুনোমাছ ভাজা আর পান্তা আনিয়া চালার মেঝেতে রাখিল। পলাশ সেইগুলি তৃপ্তি করিয়া খাইয়া কোমরে একটি গামছা বাঁধিয়া ঢেঁকুর তুলিতে তুলিতে ক্ষেতের পানে চলিয়া গেল।
বেলা গড়াইয়া মধ্যাহ্ন আসিতেছে। পলাশ রায়-পুষ্করিণীতে স্নান করিতেছিল। বৃদ্ধ খগেন দাদু গামছা কাঁধে আসিয়া পুষ্করিণীর ঘাটে বসিয়া স্নানরত নগেন দাদুর উদ্দেশ্যে বলিলেন, ”বুঝলে নগেন প্রদীপের ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ শুনলাম। ”নগেন দাদু বলিলেন, ”কেন কি হল?” উত্তরে খগেন দাদু বলিলেন, ”কারখানার মেশিনে নাকি তার ডান হাতটা কেটে গেছে। শহরের হাসপাতালে ভর্তি আছে।” পলাশ নিশ্চুপ থাকিয়া দুই দাদুর কথোপকথন শুনিতেছিল। অকস্মাৎ কি হইল সে সেই অবস্থায় জল হইতে উঠিয়া গৃহে ফিরিল। তাহাকে দেখিয়া তাহার মাতা বলিল, ”কাপড়টা ছাড় আমি ভাত বাড়ছি।”
”আমি এখন খাব না,” বলিয়া দ্রুত কাপড় বদলাইয়া পলাশ বাহির হইয়া গেল। তাহার মাতা ইহা দেখিয়া পশ্চাতে হাঁকিয়া বলিল, ”এই অসময়ে কোথায় যাস?” পলাশ কোনো উত্তর করিল না।
পলাশ হাসপাতালে আসিয়া তাহার বন্ধুর খোঁজ করিয়া সোজা শিমুলের বেডের নিকট পৌঁছাইল। দেখিল শিমুলের মাতা পুত্রের শিয়রে বসিয়া রহিয়াছে। বন্ধুর ডান হাতটি নাই, কাঁধ বরাবর একটি ব্যান্ডেজ বাঁধা। পলাশ থমকিয়া দাঁড়াইল, কি বলিয়া কথা আরম্ভ করিবে ইহা চিন্তা করিয়া ইতস্তত বোধ করিতে লাগিল। শিমুল হাসপাতালের জানালা দিয়া বাহিরের খোলা আকাশটার পানে চাহিয়াছিল। মস্তক সহ দৃষ্টি ঘুরাইতেই সে দেখিল পলাশ অনতিদূরে দাঁড়াইয়া তাহার পানে চাহিয়া আছে, তাহার দুই চক্ষু বহিয়া টপটপ করিয়া অশ্রু ঝরিয়া যাইতেছে। এই দৃশ্যে শিমুল আর নিশ্চুপ রহিতে পারিল না, সে চক্ষুর ইশারায় তাহাকে নিকটে ডাকিল। দুই বন্ধু অদ্যও এইমুহূর্তে বাক বিনিময় করিতে পারিল না শুধু চোখের জলে তাহাদের কথোপকথন হইল। ইহা দেখিয়া শিমুলের মাতাও স্থির রহিতে পারিলেন না তাহারও দুই চক্ষুপল্লব অশ্রু সিক্ত হইল। হৃদয়ের বন্ধন যে ঠুনকো নহে অশ্রুই তাহা প্রমাণ করিয়া দিল ।

Loading

One thought on “হৃদয়ের বন্ধন

Leave A Comment